কিডনির পয়েন্ট কত হলে ডায়ালাইসিস করতে হয় জানুন
কিডনি বা বৃক্ক আমাদের দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। বর্তমানে আমাদের অসচেতন জীবনযাপনের দরুণ কিডনি রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এজন্য সবাইকে কিডনির সুস্থতার প্রতি লক্ষ রাখা জরুরি। প্রস্রাবের সমস্যা সহ কিডনি রোগের অন্যান্য লক্ষণ যেমন হাত পায়ে পানি আসা, ক্ষুধামন্দা, জ্বর, চর্মরোগ, কোমর ব্যথা ইত্যাদি দেখা দিলে কিডনি ফাংশন টেস্ট করিয়ে চিকিৎসকের যথাযথ পরামর্শ নিতে হবে। কিডনি একেবারে বিকল হয়ে গেলে ডায়ালাইসিস করাতে হয় তবে প্রাথমিকভাবে ওষুধেই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আজকে আমরা জানব কিডনির পয়েন্ট কত হলে ডায়ালাইসিস করতে হয় । এছাড়া Dialysis পদ্ধতি সম্পর্কেও নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
এই পোস্টের সার সংক্ষেপ
ডায়ালাইসিস কী?
মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর শরীরে শারীরিক বিভিন্ন কার্যকলাপের দরুণ বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয়। এসব বর্জ্য শরীর থেকে বের করে দেয়া অত্যন্ত জরুরি যা একজন সুস্থ মানুষের দেহে বৃক্ক করে থাকে। কিন্তু কিডনি অকেজো হয়ে গেলে দেহ থেকে বর্জ্য অপসারিত হয়না এবং রক্তে তা জমা হয়। ফলাফলস্বরূপ রোগীর হাত পা ফুলে যায় যাকে অনেকে পানি আসা বলে থাকে। মূলত কিডনি দেহে ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে। কিডনি শরীরে প্রবাহিত সমস্ত রক্ত ছেকে পানির সাথে মিশিয়ে দূষিত পদার্থ মূত্র হিসেবে বের করে দেয়। কিডনি কাজ না করলে কৃত্তিম পদ্ধতি ব্যবহার রক্ত পরিশুদ্ধ করা হয়। এই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির নামই ডায়ালাইসিস।
ডায়ালাইজার নামক কৃত্রিম ছাঁকনি দিয়ে এটি করা হয়। ছাঁকন প্রক্রিয়া করা হয় তাকে বলা হয় ডায়ালাইজার। বৃক্ক বিকল হলে হাত বা অন্য জায়গার শিরা এবং ধমনীর সাথে dialysis মেশিন সংযোগ করা হয়। যাতে রক্ত টিউব দিয়ে dialysis মেশিনে রাখা তরলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং ব্যাপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রক্ত হতে বর্জ্য পদার্থ সূক্ষ্ম ছাঁকন প্রক্রিয়ায় বের হয়ে আসে। অবশেষে পরিশোধিত রক্ত আবার দেহে প্রবেশ করে। ডায়ালাইসিস রক্তের রাসায়নিক পদার্থ যেমন পটাসিয়াম , সোডিয়াম , বাইকার্বোনেটের মাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এটি সাধারণভাবেই একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া তবে কিডনি বিকল হলে এবং কিডনি প্রতিস্থাপনের কোনো অবস্থা না থাকলে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করার মাধ্যমেই রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন।
কী কী ধরনের ডায়ালাইসিস রয়েছে?
কিডনি রোগের চিকিৎসায় ডায়ালাইসিস অত্যন্ত কার্যকর একটি পদ্ধতি। সাধারণত দুই ধরনের ডায়ালাইসিস করানো হয়ে থাকে –
Hemodialysis
এই ক্ষেত্রে এক বিশেষ কৃত্তিম কিডনির মত পরিবেশ তৈরি করা হয় যার সাহায্যে অতিরিক্ত পানি, রাসায়নিক পদার্থ ও তরল রক্ত থেকে বের করা হয় । হাতে বা পায়ে একটি ছোট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শরীরের ভেতরে আর্টারি যুক্ত করে রক্তের এক বৃহৎ ভেসেল তৈরী করা হয় যাকে ফিসচুলা বলা হয় । যদি কখনও রক্তের ভেসেল ফিসচুলা তৈরি করতে না পারে সেক্ষেত্রে চামড়া কেটে একটি প্লাস্টিকের টিউব চিকিৎসক প্রতিস্থাপন করে থাকেন যা আর্টারি ও ভেইনকে যুক্ত করে। এই পদ্ধতিকে গ্রাফ্ট বলা হয় । অনেকসময় রোগীর গলার শিরায় একটি সূক্ষ্ম প্লাস্টিকের টিউব যাকে ক্যাথিটার বলা হয় তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
Peritoneal Dialysis
এই প্রক্রিয়ায় শরীরের ভিতরে রক্ত পরিশোধন করা হয় । একটি অস্ত্রোপচার করার পর চিকিৎসক রোগীর শরীরের নিচের অংশে একটি প্লাস্টিকের টিউব প্রবেশ করান যাকে বলা হয় ক্যাথিটার । চিকিৎসা চলাকালীন শরীরের নিচের অংশে বা পেরিটোনিয়াল ক্যাভিটিতে ধীরে ধীরে ডায়ালাইসেট দেওয়া হয় ক্যাথিটারের মাধ্যমে। এ সময় রক্ত শরীরের শিরা ও ধমনীতে থাকে । অতিরিক্ত তরল এবং দূষিত পদার্থ এ প্রক্রিয়ায় রক্ত থেকে বেরিয়ে আসে।
কিডনি রোগ নির্ণয় কীভাবে করবেন এবং কী ব্যবস্থা নিবেন?
কিডনি ফাংশন টেস্ট- একজন সুস্থ মানুষের দেহের দুটি বৃক্ক বা কিডনি দেহ থেকে সকল বর্জ্য অপসারণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিডনি ফাংশন টেস্ট এর মাধ্যমে মূলত জানা হয় যে, আপনার কিডনি এই বর্জ্য অপসারণের কাজ কতটা সফলভাবে করতে পারছে। সাধারণত রক্ত বা প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। রক্তে জমা হওয়া বিভিন্ন বর্জ্য এর পরিমাণ নির্ণয় করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে রোগীর ডায়ালাইসিস করানো প্রয়োজন কিনা। এ পরীক্ষায় গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেশন রেট (জিএফআর),রক্তে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ও সিরাম ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বের করা হয়।
আপনি এগুলো পছন্দ করবেন
কিডনির পয়েন্ট কত হলে ডায়ালাইসিস করতে হয়?
- কিডনি ফাংশন টেস্ট করিয়ে আপনি আপনার কিডনির সুস্থতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। সেক্ষেত্রে জিএফআর পরীক্ষার ফল ৬০ বা এর বেশি হলে আপনার কিডনি সুস্থ আছে এবং ঠিকভাবে রক্ত পরিশোধন করতে পারছে। তবে ৬০বের নিচে হওয়া মানে হল কিডনির রোগ আছে এবং ১৫ এর নিচে হওয়া মানে হল কিডনি ফেইলিউর হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনার কিডনি রক্ত পরিশুদ্ধ করার কাজ সঠিকভাবে করতে পারছেনা। আপনাকে বৃক্ক প্রতিস্থাপন বা ডায়ালাইসিস করাতে হবে।
- এছাড়া কিডনির সুস্থতা নির্ধারণে প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হওয়ার পরিমাণ বের করা হয়। অ্যালবুমিন একটি আমিষ যা রক্তে পাওয়া যায়। সচল ও সুস্থ কিডনি এই আমিষকে প্রস্রাবের সাথে বের হতে দেয়না। তবে বৃক্ক বিকল হলে প্রস্রাবের সাথে এই আমিষ হওয়ার পরিমাণ বেড়ে যেতে থাকে। যদি প্রস্রাবে অ্যালবুমিনের পরিমাণ ৩০ এর নিচে থাকে তাহলে তা সুস্থ বৃক্ককে নির্দেশ করে। এটি ৩০ এর উপরে থাকা মানে আপনার বৃক্ক সঠিকভাবে কাজ করছেনা এবং আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।
- সাধারণত chronic kidney disease (CKD) এর প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়ালাইসিস এর প্রয়োজন হয় না। নিয়মিত চেক আপ, ওষুধ, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ্যমে বেশ কয়েক বছর ডায়ালাইসিস ছাড়াই CKD এর রোগী সাধারণভাবে বেঁচে থাকতে পারবেন। তবে কিডনির ১৫% এর কম অংশ কাজ করে তাহলে আপনাকে অবশ্যই ডায়ালাইসিস এর দিকে অগ্রসর হতে হবে। এসব ক্ষেত্রে রোগীর কিডনি অকেজো হয়ে পড়তে থাকে এবং রক্ত থেকে দূষিত পদার্থ বের করে দিতে ব্যর্থ হয়।
- একজন সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে ক্রিয়েটিনিন স্তর পুরুষের জন্য থাকে ০.৭-১.৩ মিলিগ্রাম/ডেসি লিটার এবং মহিলাদের জন্য থাকে ০.৬- ১.১ মিলিগ্রাম/ডেসি লিটার। রক্তে ক্রিয়েটিনিন এর পরিমাণ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ২ মিলিগ্রাম/ডেসি লিটার এর বেশি এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রে ৫ মিলিগ্রাম/ডেসি লিটার এর বেশি হলে তা অকেজো কিডনিকে নির্দেশ করে এবং এক্ষেত্রে রোগীর ডায়ালাইসিস করানোর প্রয়োজন।
শেষ কথা
কিডনির রোগ মোটেই অবহেলা করার কোনো বিষয় নয়। কিডনির জটিলতা দেখা দিলে আপনার অবশ্যই একজন নেফ্রোলজিস্ট বা ইউরোলজিস্টের সাথে পরামর্শ করতে হবে। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষা করে সমস্যার তীব্রতা ও অন্তর্নিহিত কারণ নির্ধারণ করবেন এবং আপনাকে সর্বোত্তম চিকিৎসা পদ্ধতির পরামর্শ দিবেন। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে তাহলে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের কথা ভাবতে হবে না। সেক্ষেত্রে আপনার চিকিৎসক সকল ওষুধের কথা বলে দিবেন। তবে শুধু ওষুধ সেবন করলেই কিডনি রোগ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না।
এজন্য আপনাকে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে, কম লবণযুক্ত খাবার খেতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে, জীবনধারা পরিবর্তন যেমন ব্যায়াম করতে হবে, উচ্চরক্তচাপ বা ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। আপনার চিকিৎসকের কথা মেনে চলুন এবং নিয়মিত চেক আপ এর মধ্যে থাকুন। আশা করা যায়, এসব মেনে চললে একজন কিডনি রোগী বেশ ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন। তবে একেবারে কিডনি বিকল হয়ে গেলে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে।