কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়

0

কিডনি বা বৃক্ক মানবদেহের প্রধান রেচন অঙ্গ। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় আমাদের শরীরে যেসব বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয় তা বৃক্ক প্রস্রাবের মাধ্যমে অপসারণ করে। মানুষের উদর গহ্বরের পেছনে মেরুদন্ডের দুপাশে বক্ষপিঞ্জরের নিচে দুটি বৃক্ক অবস্থিত। প্রতিটি বৃক্ক দেখতে অনেকটা শিম বীজের মতো এবং লালচে রঙের। বৃক্ক রোগে আক্রান্ত হলে মানবদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। আজকের এই পোস্ট কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায় এবং কিডনি রোগ সম্পর্কিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে। চলুন জেনে নেই বিস্তারিত।

কিডনির রোগ কেন হয়?

ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন এর এক জরিপে দেখা যায় বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার 10% দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ (CKD) দ্বারা আক্রান্ত, এবং প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায় কিডনি রোগের কারনে। যদি আপনার কিডনি রোগের কারণ গুলো জানা থাকে তাহলে আপনি এগুলো থেকে সতর্ক থাকতে পারেন। যেসব কারণে কিডনি রোগ হয়-

  • জন্মগতভাবে কিডনির বা মূত্রনালীর অস্বাভাবিকতা থাকলে
  • টাইপ ১ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস হলে
  • উচ্চ রক্তচাপ থাকলে
  • বর্ধিত প্রস্টেটের কারণে
  • কিডনিতে পাথর হলে
  • বংশগতভাবে কিডনির রোগ থাকলে
  • দীর্ঘ সময় ধরে ব্যথার ওষুধ সেবন করলে কিডনি অকেজো হতে শুরু করে।

কিডনির অসুস্থতার লক্ষণ

কিডনির অসুস্থতার লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। চলুন জেনে নেই কিডনি রোগের সাধারণ কিছু লক্ষণ সম্পর্কে।

  • গোড়ালি ফুলে যাওয়া।
  • হাতে বা পায়ে পানি আসা,চোখের নিচে ফোলা ভাব এক বা দুসপ্তাহের জন্য স্থায়ী হওয়া।
  • ঘনঘন প্রস্রাব অথবা প্রস্রাব কমে যাওয়া। কিডনির রোগ প্রকট হলে প্রস্রাবের সাথে রক্ত যায়।
  • কিডনির ব্যথা মেরুদণ্ড থেকে একটু দূরে,পেছনের পাঁজরের নিচের দিকে ডান বা বাম পাশে অনুভূত হয়। কোমরের দুই পাশেও এই ব্যথা হতে পারে।
  • কোনো কারণ ছাড়াই ক্লান্তি অনুভব করা।
  • কিডনির রোগ হলে বিভিন্ন রকম ত্বকের সমস্যা দেখা দেয়া। কিডনি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ দেহ থেকে ছেঁকে বের করতে না পারলে তা ত্বকের নিচে জমা হয়। তখন বিভিন্ন চর্মরোগ হয়ে থাকে। ত্বকের রঙ পরিবর্তন হতে পারে, ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।
  • মাংসপেশিতে টান লাগা। কিডনির রোগের কারণে দেহের পটাশিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাসসহ ইলেক্ট্রোলাইট এর
  • ভারসাম্য ব্যাহত হয়। তখন মাংসপেশিতে টান বা খিঁচুনি হতে পারে।
  • দীর্ঘদিন ধরে খাবারে অরুচি ও বমিভাব।

কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়

বংশগতভাবে কিডনির রোগ থাকলে বা ডায়াবেটিস ও উচ্চচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে কিডনি সমস্যার ঝুঁকি থাকে। এজন্য কিডনির সমস্যাজনিত কোনো রোগ আছে কিনা নিশ্চিত হবার জন্য কিছু রুটিন পরীক্ষা করে নেয়াই ভালো। কেননা খালি চোখে এটি বোঝার কোনো উপায় নেই।

কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়
চিত্র- সুস্থ কিডনি ও অসুস্থ কিডনি

কিডনির সুস্থতা নিশ্চিত করতে যেসব পরীক্ষা করা হয়ে থাকে তার কিছু নিয়ে এবার আলোচনা করা হবে।

প্রস্রাবের রুটিন মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা

কিডনির সুস্থতা নিরুপণে এটি একটি অত্যন্ত কার্যকরী পরীক্ষা। কিডনির অসুখের একটি অন্যতম লক্ষণ হল রোগীদের প্রস্রাবের সাথে আমিষ বা অ্যালবুমিন নির্গত হয়। অ্যালবুমিন দেহের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি আমিষ। ত

বে কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে কিডনি সঠিকভাবে কাজ করে না এবং ফলাফল স্বরূপ অ্যালবুমিন আমিষ প্রস্রাবের সঙ্গে নির্গত হয়। সাধারণ রুটিন প্রস্রাব পরীক্ষায় অনেক সময় এটি ধরা পড়েনা কেননা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্গত অ্যালবুমিনের পরিমাণ অনেক কম থাকে।

এক্ষেত্রে প্রস্রাবের মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। মাইক্রো অ্যালবুমিন টেস্ট এর ফলাফল স্বাভাবিক এর চেয়ে বেশি এলে বুঝতে হবে কিডনিতে সমস্যা রয়েছে। অনেক সময় ২৪ ঘণ্টার জমানো প্রস্রাবেও আমিষের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়ে থাকে।

রক্তের ইউরিয়া ও সিরাম ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা

কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তে ইউরিয়া ও সিরাম ক্রিয়েটিনিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এজন্য কিডনির সুস্থতা নির্ণয়ের জন্য রক্তের ইউরিয়া ও সিরাম ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করাতে হবে।

জিএফআর বা সিসিআর টেস্ট

জিএফআর টেস্ট বা গ্লোমেরুলার ফিলট্রেশন রেট, সিসিআর বা ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স রেট টেস্ট করিয়ে কিডনি কতটুকু সুস্থ রয়েছে তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়। জিএফআর পরীক্ষার ফলাফল ৯০ এর উপরে হলে ধরে নিতে হবে আপনার কিডনি সুস্থ রয়েছে। আর যদি জিএফআর ১৫ এর নিচে নেমে যায় তাহলে বুঝতে হবে কিডনি বিকল হয়েছে এবং চিকিৎসার শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

কিডনির ৯০ ভাগ বা এর বেশি কর্মক্ষম থাকলে তা কিডনি রোগের ১ম পর্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়। ৬০-৮৯ ভাগ কাজ করলে তা দ্বিতীয় পর্যায়, ৩০- ৫৯ ভাগ কাজ করলে তৃতীয় পর্যায়, ১৫-২৯ ভাগের ক্ষেত্রে চতুর্থ পর্যায় এবং ১৫ ভাগের নিচে কাজ করলে তা পঞ্চম ভা শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

আল্ট্রাসাউন্ড টেস্ট, এমআর আই স্ক্যান ও সিটি স্ক্যান

কিডনিতে পাথর বা টিউমার হয়েছে কিনা অথবা মূত্রতন্ত্র ও প্রোস্টেটের সার্বিক অবস্থা কেমন রয়েছে সেটা বুঝতে আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করানো হয়। এটি একটি কার্যকর পদ্ধতি। স্ক্যান করানোর মাধ্যমে কিডনি দেখতে কী অবস্থায় রয়েছে বা ব্লক হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়।

রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা করুন

কিডনি বিকল হলে রোগীর দেহে অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়। এ সময়ে রক্তের হিমোগ্লোবিন, ইলেকট্রোলাইট, ক্যালসিয়াম, ফসফেট, ভিটামিন ডি ইত্যাদি পরীক্ষা দরকার হতে পারে। এছাড়া যেকোনো মানুষেরই নিয়মিত রক্তের শর্করা ও রক্তচাপ মেপে দেখা উচিত তা স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যে আছে কিনা।

কিডনি রোগের চিকিৎসা

কিডনি সম্পর্কিত জটিলতা দেখা দিলে বা বিকল হলে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। রোগের মাত্রা অনুসারে চিকিৎসক এসব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন। কিডনি রোগের সাধারণ কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

ডায়ালাইসিস- কিডনি সঠিকভাবে বর্জ্য অপসারণ করতে ব্যর্থ হলে কৃত্রিম উপায়ে রক্ত পরিশোধন করা হয় যার নাম ডায়ালাইসিস করা। এই পদ্ধতিতে কিছু যন্ত্রপাতি, টিউব ও দ্রবণের সমন্বয়ে একটি কৃত্রিম বৃক্ক তৈরি করা হয়। রোগীর দেহের ধমনী ও শিরার সাথে সূচ দিয়ে মেশিনটি যুক্ত করা হয়।ধমনী থেকে রক্ত টিউবের মধ্যে দিয়ে ডায়ালাইসিস মেশিনে যায় এবং তা পরিশোধনের পর শিরার মাধ্যমে আবার শরীরে প্রবেশ করে। এভাবে বৃক্ক অকেজো হয়ে গেলে রোগীর দেহের রক্ত পরিশোধন করা হয়।

বৃক্ক প্রতিস্থাপন – বৃক্ক একেবারে অকেজো হয়ে গেলে সুস্থ ব্যক্তির বৃক্ক নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে বৃক্ক দাতা এবং গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ ও টিস্যুর ধরন এক হতে হবে এবং দাতার দেহ থেকে বৃক্ক সংগ্রহের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বৃক্ক প্রতিস্থাপন করতে হবে।

কিডনি রোগের প্রতিরোধ

কিডনির রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি। কেননা এটি একটি জটিল রোগ। আর কথায় আছে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ করাই ভালো। কিডনি রোগ থেকে বেঁচে থাকার জন্য যেসব নিয়ম মেনে চলা উচিত সেসব নিয়ে এখন আলোচনা করা হবে।

  • কিডনি বিকলের অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। তাই উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সতর্ক হতে হবে।
  • অতিরিক্ত লবণ খাওয়া পরিহার করতে হবে। নিয়মিত রক্তচাপ মাপতে হবে এবং ওষুধ সেবন করতে হবে।
    ডায়াবেটিস রোগ বৃক্কের মারাত্মক ক্ষতি করে। তাই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন। নিয়মমাফিক জীবন পরিচালনা করুন।
  • ডায়াবেটিস রোগীরা বছরে অন্তত একবার বা দুবার কিডনি সুস্থ আছে কিনা পরীক্ষা করান।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন।
  • ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকুন।
  • কিডনি বিকল হবার আরেকটি প্রধান কারণ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া মুড়ি মুড়কির মত ব্যথার ওষুধ সেবন।
  • অতিরিক্ত ব্যথার ওষুধ খেলে কিডনি দ্রুত বিকল হয়ে যায়। প্রয়োজন না হলে ব্যথার ওষুধ পরিহার করুন।

শেষ কথা

আশা করি, উপরোক্ত লেখার মাধ্যমে কিডনি রোগ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি আজ জানতে পেরেছেন। রোগ নিরাময়ে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। নিজে সচেতন হন এবং আপনার পরিবারের মানুষদেরও এ সম্পর্কে সচেতন করুন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.